ঢাকার রাজপথ, ফুটপাত, বাসস্ট্যান্ড কিংবা কোনো পার্কের কোণে বসবাস করে এক শ্রেণির শিশু, যাদের আমরা পথশিশু বলে চিনি। তারা বই-খাতার বদলে হাতে রাখে বাদামের ঠোঙা, ফুলের ঝুড়ি কিংবা হাওয়াই মিঠাইয়ের হাঁড়ি। কেউ কেউ ভিক্ষা করে, কেউবা শুধুই ঘোরাঘুরি করে ক্ষুধা ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
এদের অনেকেরই বাবা নেই, মা অসুস্থ কিংবা অনুপস্থিত। কারও পরিবারে দিনের পর দিন চুলা জ্বলে না। অথচ জীবন চলে—প্রচণ্ড কষ্ট আর অবহেলার মাঝেও।
২০২৪ সালের ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৪ লাখ শিশু কোনো না কোনোভাবে রাস্তার সঙ্গে যুক্ত। তারা অধিকাংশই বঞ্চিত শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা, পুষ্টিকর খাবার ও নিরাপদ আশ্রয় থেকে। ২০১৭ সালের ১৬ লাখ পথশিশুর সংখ্যার তুলনায় এটি প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি।
বাংলাদেশ শিশু আইন ২০১৩ অনুযায়ী, প্রত্যেক শিশুর নিরাপদ আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, পথশিশুরা এই অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত। অনেক সময় তারা পুলিশের হয়রানি, স্থানীয় চাঁদাবাজ বা দুর্বৃত্তদের নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের জীবনকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।
ঢাকার বিজয় সরণি এলাকায় সাম্প্রতিক এক ক্ষুদ্র গবেষণায় ১০ জন পথশিশুর সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। উঠে আসে ভয়াবহ সব তথ্য—প্রায় সবাই দিনে এক কিংবা দু’বেলা খাবার পায়। নিরাপদ পানির অভাবে কেউ কেউ নোংরা ড্রেন কিংবা ফুটো পাইপ থেকে পানি সংগ্রহ করে। অনেকেই নিয়মিত গোসল করতে পারে না, নেই পরিষ্কার কাপড়, নেই সাবান।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো—নেশায় জড়িয়ে পড়ছে এসব শিশু। ১০ জনের মধ্যে ৬ জন নিয়মিত সিগারেট খায়। এই প্রবণতার পেছনে রয়েছে নিরাপত্তাহীনতা, মানসিক চাপ এবং অভিভাবকহীনতা।
গবেষণায় দেখা গেছে, অধিকাংশ পথশিশু দীর্ঘমেয়াদী মানসিক ট্রমা, একাকীত্ব ও ভয় ভীতিতে ভোগে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও সামাজিক বিভ্রান্তি দেখা যায়, যা পরবর্তীতে সমাজবিরোধী কার্যকলাপে জড়ানোর ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ছোট্ট হামজা জানায়, “আমি গাড়ির মালিক হতে চাই। কারণ সে জানে গাড়ির মালিকের অনেক টাকা থাকে, কোনো কষ্ট নাই।” অথচ বাস্তবতা হলো—তার বাবা নেই, মা অসুস্থ, আর সে প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে।
আরেকটি হৃদয়বিদারক চিত্র—আলী ও কবির, দুই ভাই, বয়স মাত্র ৮ ও ১০। তারা প্রতিদিন ভিক্ষা করে, আর রাতে ঘুমায় যেখানে জায়গা পায়—ফুটপাতে, বাসস্ট্যান্ডে কিংবা স্রেফ খোলা রাস্তায়। অপুষ্টি, চর্মরোগ আর অবহেলা যেন তাদের নিত্যসঙ্গী।
তবে আশা আছে—ঢাকায় “আপন (APON)” নামের একটি সংস্থা পথশিশুদের পুনর্বাসনে কাজ করে আসছে। তারা আশ্রয়, শিক্ষা ও মাদকমুক্ত জীবন গঠনে সহায়তা প্রদান করছে, যা অনেক পথশিশুর জীবন পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।
গবেষণায় উঠে আসে—রাষ্ট্রীয় সহায়তা তাদের জীবনে প্রায় নেই বললেই চলে। কিছু ব্যক্তি সহানুভূতির বশে খাবার বা পুরোনো কাপড় দেয় ঠিকই, তবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কিংবা পুনর্বাসন কার্যক্রম তাদের জন্য দূরের স্বপ্ন।
যদিও সরকার পরিচালিত ১০৯৮ শিশু সহায়তা হেল্পলাইন ২৪ ঘণ্টা খোলা রয়েছে, যেখানে শিশু নির্যাতন বা সহায়তার জন্য যে কেউ কল করতে পারেন, তবুও সাধারণ পথশিশুর কাছে এ সেবাগুলো পৌঁছানো এখনো চ্যালেঞ্জ।
প্রস্তাবনা:
প্রতিটি উপজেলায় মোবাইল হেলথ ক্যাম্প চালু করতে হবে, যাতে পথশিশুরা নিয়মিত প্রাথমিক চিকিৎসা ও টিকা সেবা পায়। ১৪ বছর ও তার ঊর্ধ্বে পথশিশুদের জন্য বিনামূল্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী পথশিশুদের জন্য নিরাপদ আবাসন, স্যানিটারি ব্যবস্থা এবং আত্মনির্ভরশীলতা তৈরির প্রশিক্ষণ চালু করা জরুরি। সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একত্রিত করে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম গঠন করতে হবে, যারা পথশিশুদের জন্য কাজ করবে। পথশিশুদের বিরুদ্ধে পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা ও পরামর্শ প্রদান নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার:
পথশিশুরা সমাজের বোঝা নয়—তারা অবহেলিত, কিন্তু সম্ভাবনাময়। সঠিক দিকনির্দেশনা ও সহায়তা পেলে তারাই হতে পারে আগামী দিনের উদ্যোক্তা, চিকিৎসক, শিক্ষক কিংবা সমাজ সংস্কারক। প্রয়োজন শুধু রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছা, মানবিকতা এবং দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি।
######
লেখক:
আনিকা আক্তার
সেশন :২০২১-২০২২
সেমিস্টার : ষষ্ঠ
শিক্ষার্থী , পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (BUP)।